
আমাদের এই পৃথিবী কত রহস্যে ভরা! এমন এক অঞ্চলের কথা বলবো যেখানে প্রযুক্তি নীরব হয়ে যায়। ভাবছেন কোথায় এমন জায়গা? আজ আমরা জানবো পৃথিবীর তেমনই এক অবিশ্বাস্য অঞ্চলের কথা, যেখানে কোনো মোবাইল ফোন কাজ করে না, কোনো রেডিও সিগনাল প্রবেশ করে না, এমনকি স্যাটেলাইটও সেখানে নীরব! চলুন, জেনে নিই দ্য সাইলেন্ট জোন-এর বিস্ময়কর গল্প।
আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া রাজ্যের গ্রিন ব্যাংক নামের ছোট্ট এক শহরে আছে এই নীরব এলাকা। এর নাম ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাশনাল রেডিও কোয়ায়েট জোন। এটি ১৩,০০০ বর্গ মাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে ছড়ানো। এই বিশাল অঞ্চলে আপনার মোবাইল ফোন, ওয়াই-ফাই, এমনকি রেডিও – কোনো কিছুই কাজ করবে না। এখানে প্রতিটি যন্ত্র নীরব, প্রতিটি সিগনাল নিষ্ক্রিয়। মনে হতে পারে, এটা যেন সময়ের থেকে বিচ্ছিন্ন এক অঞ্চল। কিন্তু কেন এমনটা হয়? কেন এখানে সব ধরনের ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন নিষিদ্ধ?
এর পেছনের মূল কারণ হলো ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরি এর গ্রিন ব্যাংক টেলিস্কোপ। এটি বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সংবেদনশীল স্টিয়ারেবল রেডিও টেলিস্কোপ। এটি এতই সংবেদনশীল যে, মহাকাশ থেকে আসা ক্ষীণতম রেডিও তরঙ্গকেও এটি শনাক্ত করতে পারে।
আমাদের মোবাইল ফোন বা ওয়াই-ফাই রাউটার থেকে নির্গত সাধারণ রেডিও সিগনালও এর জন্য বিশাল এক "শব্দ দূষণ" তৈরি করে, যা মহাজাগতিক গবেষণায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায়। তাই, টেলিস্কোপের কার্যক্রম নিশ্চিত করতে এই বিশাল অঞ্চলটিকে 'সাইলেন্ট জোন' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এই সাইলেন্ট জোনের ভেতরে বসবাসকারী প্রায় কয়েক হাজার মানুষের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানকার বাসিন্দারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন না, ওয়াই-ফাই নেই, এমনকি মাইক্রোওয়েভ ওভেনও নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি শক্তিশালী হতে পারবে না।
তাদের যোগাযোগ মূলত ল্যান্ডলাইন ফোন বা তারযুক্ত ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। অনেকেই এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে বসবাস করতে আসেন, কারণ তারা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের প্রতি সংবেদনশীল। এই অদ্ভত নীরবতা তাদের জন্য এক আশীর্বাদ।
এই অঞ্চলের শিশুরা ছোটবেলা থেকেই এমন এক জীবনধারায় অভ্যস্ত, যেখানে স্ক্রিন টাইম বা ডিজিটাল যোগাযোগের উন্মাদনা নেই। তারা প্রকৃতির কাছাকাছি বড় হয়, বই পড়ে, হাতে-কলমে কাজ শেখে। এখানকার মানুষরা এক ভিন্ন প্রযুক্তির সঙ্গে বসবাস করে, যা রেডিও টেলিস্কোপের কার্যকারিতায় হস্তক্ষেপ করে না। এমনকি গাড়িগুলোতেও স্পার্ক প্লাগ থেকে যেন রেডিও ইন্টারফেস না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। এটা আধুনিকতার মাঝে এক দারুণ ব্যতিক্রমী জীবন!
এই নীরবতার পেছনে আছে মহাবিশ্বের গভীর অনুসন্ধান,রয়েছে এক মহৎ উদ্দেশ্য। গ্রিন ব্যাংক টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করে। এটি ব্ল্যাক হোল, দূরবর্তী গ্যালাক্সি, তারাদের জন্ম এবং মহাবিশ্বের মৌলিক গঠন নিয়ে গবেষণায় অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। আমাদের গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের বাইরে কী আছে, বা মহাবিশ্বের সৃষ্টি কিভাবে হলো, সে সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য এটি আমাদের জানায়। এই টেলিস্কোপের সংবেদনশীলতা এতটাই বেশি যে, যদি চাঁদে একটি মোবাইল ফোন চালু করা হয়, তবে সেই সিগনালও এটি ধরতে পারবে!
দ্য সাইলেন্ট জোন শুধু প্রযুক্তির অনুপস্থিতি নয়, এটি মহাজাগতিক অনুসন্ধানের জন্য মানবজাতির এক বিশাল আত্মত্যাগ। এটি প্রমাণ করে যে, মাঝে মাঝে নীরবতাই সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে, বিশেষ করে যখন আমরা মহাবিশ্বের অসীম রহস্যের দিকে কান পাতি। এই নীরব অঞ্চলটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবীতে এখনও এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে প্রকৃতি এবং বিজ্ঞান এক অসাধারণ ভারসাম্য বজায় রেখে ।“দ্য সাইলেন্ট জোন” আমাদের শেখায় বিজ্ঞান ও প্রকৃতির এক অনন্য সমন্বয়।
মন্তব্য করুন